সেন্টমার্টিনস দ্বীপ টেকনাফ

সেন্টমার্টিনস দ্বীপ টেকনাফ



সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ  বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণ অংশে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলা থেকে ৯ কিমি দক্ষিণে গড়ে ওঠা একটি ছোট দ্বীপ। মায়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে ৮ কিমি পশ্চিমে নাফ নদীর মুখে দ্বীপটি অবস্থিত। ৯২°১৮´ ও ৯২°২১´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২০°৩৪´ ও ২০°৩৯´ উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে দ্বীপটির অবস্থান। স্থানীয় জনসাধারণ এটিকে নারিকেল জিনজিরা নামে চেনে। সর্বতোভাবে দ্বীপটি সমতল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা থেকে ৩.৬ মিটার উপরে। মূল ভূখন্ড এবং দ্বীপের মধ্যবর্তী ৯.৬৬ কিমি প্রশস্ত প্রণালী দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমের উন্মুক্ত সাগরের তুলনায় অনেক অগভীর। এখানে পশ্চিম-উত্তর পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে ১০-১৫ কিমি প্রবাল প্রাচীর।


দ্বীপটি ৭.৩১৫ কিমি দীর্ঘ এবং উত্তর-উত্তরপশ্চিম এবং দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিক জুড়ে বিন্যস্ত। ভৌগোলিকভাবে এটি তিনটি অংশে বিভক্ত। উত্তরাঞ্চলীয় অংশকে বলা হয় নারিকেল জিনজিরা বা উত্তর পাড়া এবং এ অংশ ২,১৩৪ মিটার দীর্ঘ ও ১,৪০২ মিটার প্রশস্ত। দক্ষিণাঞ্চলীয় অংশটি দক্ষিণ পাড়া হিসেবে পরিচিত, যা ১৯২৯ মিটার দীর্ঘ এবং এর সাথে সংযুক্ত রয়েছে দক্ষিণ পূর্ব দিকে বিস্তৃত একটি সংকীর্ণ লেজের মতো এলাকা, যার সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ৯৭৫ মিটার। একটি সংকীর্ণ কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা মধ্য পাড়া দুইটি অংশকে সংযুক্ত করেছে। বেল্ট বা ফিতার মতো এই অঞ্চলটির দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ যথাক্রমে ১৫২৪ মিটার ও ৫১৮ মিটার এবং সংকীর্ণতম অংশটি গলাচিপা নামে পরিচিত। মূল দ্বীপ ছাড়াও এখানে কয়েকটি ১০০ থেকে ৫০০ বর্গ মিটার আয়তন বিশিষ্ট ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে, যেগুলোকে স্থানীয়ভাবে ছেড়াদিয়া বা সিরাদিয়া নামে অভিহিত করা হয়, যার অর্থ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। উত্তর পাড়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে একটি অগভীর উপহ্রদ (lagoon) রয়েছে এবং জোয়ারের সময় পশ্চিম তীরের একটি সংকীর্ণ নদীখাতের মাধ্যমে এটির সাথে সমুদ্রের সংযোগ ঘটে। উত্তর পাড়ার পৃষ্ঠমৃত্তিকা গঠিত হয়েছে বালি এবং ঝিনুক শামুকের খোলস সহযোগে। দক্ষিণ পাড়া অঞ্চলে রয়েছে দুটি ক্ষুদ্র মৃত উপহ্রদ এবং একটি বিস্তৃত জলাভূমি। মাছ সংগ্রহস্থল, বাজার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ শুধুমাত্র উত্তর পাড়াতেই অবস্থিত।

টেকনাফ এবং সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের মধ্যে নিয়মিত লঞ্চ ও দেশী নৌকা চলাচল করে। দ্বীপের অধিবাসীর সংখ্যা ৩৭০০ এবং এদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। এই মৎস্যজীবী পরিবারের সংখ্যা ৫৩৫। দ্বীপে ১৮২টি বন্য জীব প্রজাতির অস্তিত্ব চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৪টি প্রজাতি উভচর গোত্রের, ২৮টি  সরীসৃপ, ১৩০টি পাখি এবং স্তন্যপায়ীর সংখ্যা ২০। দ্বীপের উত্তরাংশে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার মাস পর্যটন কাল। দ্বীপের সর্বাপেক্ষা ঘনবসতি পূর্ণ অংশ হল জিনজিরা। সমস্ত দ্বীপে স্বাদু পানির অভাব রয়েছে। শুধুমাত্র অল্প কিছু পুকুর এবং কিছু সংখ্যক নলকূপের মাধ্যমে সমগ্র দ্বীপে পানীয় জল এবং চাষাবাদের জন্য স্বাদু পানি সরবরাহ করা হয়।

যদিও দ্বীপটি মৌসুমি বায়ু অঞ্চলের আওতায় পড়েছে, তথাপি এখানকার জলবায়ু সমুদ্র দ্বারা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত। প্রধান গাছপালার মধ্যে রয়েছে নারিকেল, সুপারি এবং বাঁশ। দ্বীপজুড়ে রয়েছে প্রচুর নারিকেল গাছ এবং জিনজিরা এলাকায় এর পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। দ্বীপের মৃত্তিকা খুব একটা উর্বর নয়। প্রধান ফসল পিঁয়াজ, তরমুজ এবং কিছু পরিমাণ ধান।


সেন্ট মার্টিনস দ্বীপ
দ্বীপটির ভূতাত্ত্বিক গঠন খুবই সাধারণ এবং একটি উত্থিত উত্তলভঙ্গ  দ্বারা নির্দেশিত। দক্ষিণপাড়ার পশ্চিম তীর জুড়ে উত্তলভঙ্গ অক্ষের সামান্য চিহ্নিত করা যায়। অক্ষের প্রকটিত অংশ উত্তর-উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রসারিত, প্রায় দ্বীপের সঙ্গে সমান্তরাল। উত্তর-পশ্চিম উপকূল রেখা জুড়ে অক্ষের প্রায় সমান্তরাল চ্যুতি রয়েছে। সেন্ট মার্টিনস চুনাপাথর, ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট কোকুইনা স্তর এবং প্রবালগুচ্ছ (প্রবাল সৃষ্ট চুনাপাথর) দ্বারা গঠিত। অত্যন্ত প্রবেশ্য এবং রন্ধ্রযুক্ত হওয়ার জন্য ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর যেখানে পলল স্তরের নিচে সঞ্চিত হয় সেখানে একটি ভূগর্ভস্থ জলস্তরের সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক  সামুদ্রিক বালি এবং ঝিনুক-শামুকের খোলস সৃষ্ট চুনাপাথর স্বাদু পানির প্রধান উৎস।

সমস্ত দ্বীপ জুড়ে ভাটার পানি স্তরের অত্যন্ত কাছাকাছি ক্ষুদ্র খাড়িসমূহে বিভিন্ন ধরনের জীবিত ছোট ছোট প্রবাল গোষ্ঠী দেখা যায়। দ্বীপের চারপাশে অগভীর সমুদ্রেও এদের দেখা যায়। প্রধানত সৈকত শিলা (beach rock) জমে থাকা পাথরে এবং চুনযুক্ত বেলেপাথরে বেড়ে ওঠে। মৃত প্রবাল গোষ্ঠীগুলি ক্ষুদ্র জলমগ্ন নিম্নভূমিতে জোয়ারভাটা উভয় সময়েই দেখা যায়। এদের কিছু কিছু ভাটার সময়ের পানি স্তরের চেয়ে প্রায় ৩.৫০ মিটার উপরেও পরিদৃষ্ট হয়। সর্বাপেক্ষা প্রাচীন প্রবাল জীবাশ্মটি নবীন প­াইসটোসিন যুগের শেষ পর্যায়ের, এর বয়স ৩৩.২৩৮ বৎসর (c14 dating)। দ্বীপটিতে হলোসিন যুগের উত্থানের পরিষ্কার চিহ্নটি হলো দক্ষিণ পাড়া সমুদ্রতীরে ৩.০ মিটার কোকুইনা চুনাপাথরের উচ্চভূমির আবির্ভাব। এই চুনাপাথর স্তরের নিম্ন অংশের বয়স ৪৫০ বৎসর এবং উপরের অংশের ২৯২ বৎসর। এই তথ্য থেকে দেখা যায় দ্বীপের গড় উত্থানের হার বছরে ১৯.০ মিমি। কোকুইনা স্তরটি বর্তমান জোয়ারকালীন পানির স্তরের চেয়ে ১.৫ মিটার উপরে এবং পূর্বাঞ্চলীয় চ্যুতি স্তূপের ঊর্ধ্বক্ষিপ্ত অংশে অবস্থান করে।

উত্থিত মৃত প্রবালসমূহের মধ্যে বিশেষ করে পোরাইটিস  প্রজাতি, একরোপোরা প্রজাতি, সাইপোসট্রিয়া  এবং পে­টিজেরিন  প্রজাতিগুলি আরও নিচের স্তরে আবির্ভূত হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে। অর্থাৎ এরা সেই স্তরের আরও উপরে উঠে এসেছে যেখানে বর্তমানে তারা অবস্থান করছে। উত্থিত মৃত প্রবালগুলির রেডিওকার্বন ডেটিং এই অবস্থা প্রমাণ করে যে মৃত প্রবালগুলির উত্থান খুবই সাম্প্রতিক সময়ে, প্রকৃতপক্ষে এগুলো এখনো বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে। এই বাস্তবতা নির্দেশ করছে যে, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের উত্থান হচ্ছে; ফলে এর পরিবেশ এখন দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হিসেবে এর বৃদ্ধি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুকূল নয়। দেশের এই একমাত্র প্রবাল দ্বীপটির উত্থানের শুরু হয়েছিল কমপক্ষে গত সর্বোচ্চ হিমবাহ যুগ থেকে (অর্থাৎ আনুমানিক 40,000 বৎসর পূর্বে)।

No comments

Thanks

Theme images by compassandcamera. Powered by Blogger.