মেঘনা নদী বাংলাদেশে
মেঘনা নদী বাংলাদেশের
মেঘনা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম। মেঘনা হিমালয় বলয় বহির্ভূত নদী। সুরমা নদী আজমিরীগঞ্জের ভাটি থেকেই কোন কোন ক্ষেত্রে মেঘনা নামে পরিচিত। সুরমা-মেঘনা নদীপ্রবাহ মদনা নামক স্থানের পরে প্রায় ২৬ কিমি ভাটিতে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের কাছে ধলেশ্বরী নাম ধারণ করে। উত্তরের অংশে ধলেশ্বরী নদী অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ এবং দিক পরিবর্তনশীল। নদীর এই নামকরণ মেঘনা নামের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর। এই অসুবিধা দূর করার জন্য আজমিরীগঞ্জের ভাটিতে মূল প্রবাহ যেখানে ধনু এবং ঘোড়াউত্রা নদীর মিলিত স্রোতের সঙ্গে মিশেছে, সে পর্যন্ত নদীটির নাম সুরমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই স্থানটি কুলিয়ারচরের ৫ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। এই সঙ্গম স্থলের পর থেকেই নদীটি মেঘনা নামে পরিচিত।
মেঘনা নদী দুটি অংশে বিভক্ত। কুলিয়ারচর থেকে ষাটনল পর্যন্ত আপার মেঘনা। নদীর এই অংশ অপেক্ষাকৃত ছোট। ষাটনল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত অংশ লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত। এই অংশে নদী বিশাল এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মোহনার অধিকারী। এই লোয়ার মেঘনা দেশের অন্য দুটি প্রধান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিও সাগরে বয়ে নিয়ে যায়। বিশালত্বের কারণে মেঘনার এই অংশ একটি স্বতন্ত্র নদী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রবাহ পথে মেঘনা থেকে ছোট ছোট বিভিন্ন শাখা বেরিয়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি বহন করে পুনরায় মেঘনাতে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে তিতাস, পাগলী, কাঠালিয়া, ধনাগোদা, মতলব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেঘনা নদী স্বয়ং এবং এর উল্লিখিত শাখা-প্রশাখা ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে পানি পেয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি নদীগুলো হচ্ছে- গোমতী, হাওড়া, কাগনী, সোনাইবুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকড়াই, কুরোলিয়া, বালুজুড়ি, সোনাইছড়ি, হান্দাছড়া, জঙ্গলিয়া ও ডাকাতিয়া। এই নদীগুলো সংগত কারণেই বন্যাপ্রবণ।
ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী এবং এর কিছু ভাটিতে ষাটনলের কাছে ধলেশ্বরী নদী আপার মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। এখানে আড়াআড়িভাবে মেঘনার বিস্তৃতি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মেঘনার উপরের অংশ পূর্বদিক থেকে ত্রিপুরার পাহাড়ি নদীর পানি প্রবাহ, আর পশ্চিমে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। ষাটনলের কাছে পূর্বদিক থেকে আসা মেঘনার পানি স্বচ্ছ ও নীল, আর পশ্চিম থেকে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর পানি ঘোলা। এই দুই নদীর ধারা নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, নদীর অর্ধেক অংশ স্বচ্ছ ও নীল (পূর্ব দিকের অংশ) এবং অপর অর্ধাংশে ঘোলা পানি, কেউ কারও সঙ্গে না মিশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। ষাটনলের ১৬ কিমি ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মিলিত স্রোত পদ্মা নামে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখান থেকেই নদীটি বিশাল আকৃতি ধারণ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং এই সঙ্গম স্থলের ভাটির অংশই লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত। এখানে নদীর বিস্তৃতি প্রায় এগারো কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০ কিমি।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনা মূলত সুরমা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও গঙ্গার মিলিত স্রোতধারা। মেঘনার নিম্নাংশে অর্থাৎ লোয়ার মেঘনাতে প্রচুর চর গঠিত হয়েছে। এখানে মেঘনার তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়, এগুলো হচ্ছে- ইলশা বা তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর এবং বামনী। তেঁতুলিয়া নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার বিস্তৃত। এটি ভোলাকে বরিশালের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। নদীর এই অংশেরই পশ্চিম মুখে রামনাবাদ দ্বীপ অবস্থিত। শাহবাজপুরের বিস্তৃতি প্রায় আট কিলোমিটার। এটি ভোলাকে রামগতি এবং হাতিয়া দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বামনী একসময় রামগতি ও চরলক্ষ্যা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং এটিই ছিল লোয়ার মেঘনার মূলধারা। কিন্তু বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
মেঘনা অত্যন্ত গভীর এবং নাব্য একটি নদী। সারা বছরই নদীতে নৌচলাচল সম্ভব হয়। ছোটবড় নৌকা এবং স্টিমার প্রায় সারা বছরই এই নদী পথে যাতায়াত করে। বর্ষা মৌসুমে নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যেরবাজার পর্যন্ত মেঘনাতে জোয়ারভাটার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। শুকনো মৌসুমে এই জোয়ারভাটা রেখা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মারকুলি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে মেঘনা নদীর পানি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে লবণাক্ততা নিরূপণ করা হয়।
মেঘনা নদীর পানিসমতল উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাইর হাট, সিলেট, ছাতক, সুনামগঞ্জ, মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, অষ্টগ্রাম, ভৈরব বাজার, নরসিংদী, বৈদ্যেরবাজার, ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে পানি সমতল গেজ আছে। ভৈরব বাজারে সর্বোচ্চ ৭.৬৬ মিটার এবং সর্বনিম্ন ০.৮৮ মিটার সমতল লক্ষ্য করা গেছে। সিলেট এবং ভৈরব বাজারে মেঘনা নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ভৈরব বাজারে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ১৯,৪৮৫ ঘনমিটার এবং সর্বনিম্ন ৬,৬২৭ ঘনমিটার পানি প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশে সুরমা-মেঘনার মোট দৈর্ঘ্য ৬৭০ কিলোমিটার। নদীটির উপরের অংশ (আপার মেঘনা) নিম্নাংশের (লোয়ার মেঘনা) চেয়ে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। ভৈরব বাজারে নদীর বিস্তার প্রায় এক কিলোমিটার, ষাটনলের কাছে পাঁচ কিলোমিটার এবং চাঁদপুরের কাছে এগারো কিলোমিটার। মোহনায় ইলশা বা তেঁতুলিয়া এবং শাহবাজপুরের একত্রে বিস্তৃতি প্রায় ৪০ কিলোমিটার। রামনাবাদ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাকে মেঘনার মোহনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
সুরমা-মেঘনার উভয় তীরে বহু জনপদ, শহর, বন্দর, কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা প্রভৃতি জেলা শহর উল্লেখযোগ্য। নৌ ও বাণিজ্য বন্দর হিসেবে মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, কুলিয়ারচর, ভৈরব বাজার, চাঁদপুর (পুরান বাজার), রামদাসপুর, কালুপুর, দৌলতখান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আশুগঞ্জ তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা এই নদীর তীরে অবস্থিত।
হাওর এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা বন্যাপ্রবণ একটি নদী। বর্ষার শুরুতেই হাওর এলাকা বৃষ্টির পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। হাওরের এই সঞ্চিত পানির সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন পাহাড়িয়া নদী থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ এবং সুরমা-মেঘনা নদী এই বিপুল জলরাশি যথাযথরূপে ধারণ করতে না পারার ফলে নদীর তীর উপচিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। নদীর ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত এই পানির কারণে প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই অকাল প্লাবন দেখা দেয় এবং জনমানব, গবাদিপশু ও কৃষি ফসলের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা নামে দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই পরিকল্পনায় মেঘনা নদীর পার্শ্বে বাঁধ নির্মাণ করে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর উপর আড়-বাঁধ দিয়ে প্রায় ১,৮০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করে কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলার প্রায় ৪০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান সম্ভব হবে। উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১২৫ কিমি নদীর তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যার অংশবিশেষ মেঘনা তীরের অন্তর্ভুক্ত। এই বেড়িবাঁধের সাহায্যে ঐসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও লবণাক্ততারোধ করে কৃষি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছে। এই বেড়িবাঁধগুলো ভূমি পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হবে।
মেঘনা নদী বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী এবং পৃথিবীর বৃহৎ নদীগুলোর অন্যতম। মেঘনা হিমালয় বলয় বহির্ভূত নদী। সুরমা নদী আজমিরীগঞ্জের ভাটি থেকেই কোন কোন ক্ষেত্রে মেঘনা নামে পরিচিত। সুরমা-মেঘনা নদীপ্রবাহ মদনা নামক স্থানের পরে প্রায় ২৬ কিমি ভাটিতে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের কাছে ধলেশ্বরী নাম ধারণ করে। উত্তরের অংশে ধলেশ্বরী নদী অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ এবং দিক পরিবর্তনশীল। নদীর এই নামকরণ মেঘনা নামের সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের জন্য কিঞ্চিৎ বিভ্রান্তিকর। এই অসুবিধা দূর করার জন্য আজমিরীগঞ্জের ভাটিতে মূল প্রবাহ যেখানে ধনু এবং ঘোড়াউত্রা নদীর মিলিত স্রোতের সঙ্গে মিশেছে, সে পর্যন্ত নদীটির নাম সুরমা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই স্থানটি কুলিয়ারচরের ৫ কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। এই সঙ্গম স্থলের পর থেকেই নদীটি মেঘনা নামে পরিচিত।
মেঘনা নদী দুটি অংশে বিভক্ত। কুলিয়ারচর থেকে ষাটনল পর্যন্ত আপার মেঘনা। নদীর এই অংশ অপেক্ষাকৃত ছোট। ষাটনল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত অংশ লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত। এই অংশে নদী বিশাল এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মোহনার অধিকারী। এই লোয়ার মেঘনা দেশের অন্য দুটি প্রধান নদী গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানিও সাগরে বয়ে নিয়ে যায়। বিশালত্বের কারণে মেঘনার এই অংশ একটি স্বতন্ত্র নদী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রবাহ পথে মেঘনা থেকে ছোট ছোট বিভিন্ন শাখা বেরিয়ে ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর পানি বহন করে পুনরায় মেঘনাতে পড়েছে। এগুলোর মধ্যে তিতাস, পাগলী, কাঠালিয়া, ধনাগোদা, মতলব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেঘনা নদী স্বয়ং এবং এর উল্লিখিত শাখা-প্রশাখা ত্রিপুরার বিভিন্ন পাহাড়ি নদীর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে পানি পেয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি নদীগুলো হচ্ছে- গোমতী, হাওড়া, কাগনী, সোনাইবুড়ি, হরিমঙ্গল, কাকড়াই, কুরোলিয়া, বালুজুড়ি, সোনাইছড়ি, হান্দাছড়া, জঙ্গলিয়া ও ডাকাতিয়া। এই নদীগুলো সংগত কারণেই বন্যাপ্রবণ।
ভৈরব বাজারের কাছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদী এবং এর কিছু ভাটিতে ষাটনলের কাছে ধলেশ্বরী নদী আপার মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। এখানে আড়াআড়িভাবে মেঘনার বিস্তৃতি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মেঘনার উপরের অংশ পূর্বদিক থেকে ত্রিপুরার পাহাড়ি নদীর পানি প্রবাহ, আর পশ্চিমে ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার পানি দ্বারা সমৃদ্ধ হয়। ষাটনলের কাছে পূর্বদিক থেকে আসা মেঘনার পানি স্বচ্ছ ও নীল, আর পশ্চিম থেকে প্রবাহিত ধলেশ্বরীর পানি ঘোলা। এই দুই নদীর ধারা নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, নদীর অর্ধেক অংশ স্বচ্ছ ও নীল (পূর্ব দিকের অংশ) এবং অপর অর্ধাংশে ঘোলা পানি, কেউ কারও সঙ্গে না মিশে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার প্রবাহিত হয়েছে। ষাটনলের ১৬ কিমি ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-যমুনার মিলিত স্রোত পদ্মা নামে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখান থেকেই নদীটি বিশাল আকৃতি ধারণ করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হচ্ছে এবং এই সঙ্গম স্থলের ভাটির অংশই লোয়ার মেঘনা নামে পরিচিত। এখানে নদীর বিস্তৃতি প্রায় এগারো কিলোমিটার এবং দৈর্ঘ্য প্রায় ১৬০ কিমি।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ নদী মেঘনা মূলত সুরমা, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও গঙ্গার মিলিত স্রোতধারা। মেঘনার নিম্নাংশে অর্থাৎ লোয়ার মেঘনাতে প্রচুর চর গঠিত হয়েছে। এখানে মেঘনার তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়, এগুলো হচ্ছে- ইলশা বা তেঁতুলিয়া, শাহবাজপুর এবং বামনী। তেঁতুলিয়া নদী প্রায় ছয় কিলোমিটার বিস্তৃত। এটি ভোলাকে বরিশালের মূল ভূ-খন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। নদীর এই অংশেরই পশ্চিম মুখে রামনাবাদ দ্বীপ অবস্থিত। শাহবাজপুরের বিস্তৃতি প্রায় আট কিলোমিটার। এটি ভোলাকে রামগতি এবং হাতিয়া দ্বীপ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। বামনী একসময় রামগতি ও চরলক্ষ্যা দ্বীপের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং এটিই ছিল লোয়ার মেঘনার মূলধারা। কিন্তু বর্তমানে এর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।
মেঘনা অত্যন্ত গভীর এবং নাব্য একটি নদী। সারা বছরই নদীতে নৌচলাচল সম্ভব হয়। ছোটবড় নৌকা এবং স্টিমার প্রায় সারা বছরই এই নদী পথে যাতায়াত করে। বর্ষা মৌসুমে নারায়ণগঞ্জ জেলার বৈদ্যেরবাজার পর্যন্ত মেঘনাতে জোয়ারভাটার প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। শুকনো মৌসুমে এই জোয়ারভাটা রেখা ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মারকুলি পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে মেঘনা নদীর পানি সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে লবণাক্ততা নিরূপণ করা হয়।
মেঘনা নদীর পানিসমতল উপাত্ত সংগ্রহের জন্য কানাইর হাট, সিলেট, ছাতক, সুনামগঞ্জ, মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, অষ্টগ্রাম, ভৈরব বাজার, নরসিংদী, বৈদ্যেরবাজার, ষাটনল, চাঁদপুর, দৌলতখান এবং চর তজুমুদ্দিনে পানি সমতল গেজ আছে। ভৈরব বাজারে সর্বোচ্চ ৭.৬৬ মিটার এবং সর্বনিম্ন ০.৮৮ মিটার সমতল লক্ষ্য করা গেছে। সিলেট এবং ভৈরব বাজারে মেঘনা নদীর পানি প্রবাহের পরিমাণ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ভৈরব বাজারে প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ১৯,৪৮৫ ঘনমিটার এবং সর্বনিম্ন ৬,৬২৭ ঘনমিটার পানি প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশে সুরমা-মেঘনার মোট দৈর্ঘ্য ৬৭০ কিলোমিটার। নদীটির উপরের অংশ (আপার মেঘনা) নিম্নাংশের (লোয়ার মেঘনা) চেয়ে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। ভৈরব বাজারে নদীর বিস্তার প্রায় এক কিলোমিটার, ষাটনলের কাছে পাঁচ কিলোমিটার এবং চাঁদপুরের কাছে এগারো কিলোমিটার। মোহনায় ইলশা বা তেঁতুলিয়া এবং শাহবাজপুরের একত্রে বিস্তৃতি প্রায় ৪০ কিলোমিটার। রামনাবাদ থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাকে মেঘনার মোহনা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
সুরমা-মেঘনার উভয় তীরে বহু জনপদ, শহর, বন্দর, কল-কারখানা গড়ে উঠেছে। সেগুলোর মধ্যে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নরসিংদী, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা প্রভৃতি জেলা শহর উল্লেখযোগ্য। নৌ ও বাণিজ্য বন্দর হিসেবে মারকুলি, আজমিরীগঞ্জ, মদনা, কুলিয়ারচর, ভৈরব বাজার, চাঁদপুর (পুরান বাজার), রামদাসপুর, কালুপুর, দৌলতখান প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আশুগঞ্জ তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ফেঞ্চুগঞ্জ সারকারখানা এই নদীর তীরে অবস্থিত।
হাওর এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত মেঘনা বন্যাপ্রবণ একটি নদী। বর্ষার শুরুতেই হাওর এলাকা বৃষ্টির পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। হাওরের এই সঞ্চিত পানির সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন পাহাড়িয়া নদী থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ এবং সুরমা-মেঘনা নদী এই বিপুল জলরাশি যথাযথরূপে ধারণ করতে না পারার ফলে নদীর তীর উপচিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। নদীর ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত এই পানির কারণে প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই অকাল প্লাবন দেখা দেয় এবং জনমানব, গবাদিপশু ও কৃষি ফসলের বিপুল ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা এবং কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা নামে দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে মেঘনা উপত্যকা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে। এই পরিকল্পনায় মেঘনা নদীর পার্শ্বে বাঁধ নির্মাণ করে সিলেট, ময়মনসিংহ এবং কুমিল্লা জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং নদীর উপর আড়-বাঁধ দিয়ে প্রায় ১,৮০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। কুমিল্লা-চট্টগ্রাম পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করে কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলার প্রায় ৪০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান সম্ভব হবে। উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রায় ১২৫ কিমি নদীর তীরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যার অংশবিশেষ মেঘনা তীরের অন্তর্ভুক্ত। এই বেড়িবাঁধের সাহায্যে ঐসব এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও লবণাক্ততারোধ করে কৃষি সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়েছে। এই বেড়িবাঁধগুলো ভূমি পুনরুদ্ধারেও সহায়ক হবে।
No comments
Thanks