লক্ষীপুর শহীদ সমাধিস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া

লক্ষীপুর শহীদ সমাধিস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া


দেখতে চায় প্রকৃতির রূপ। জানতে চায় নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির রূপ, মানুষ ও তার সংস্কৃতিকে। দেখা ও জানার অদম্য আগ্রহ থেকেই মানুষ হয়ে ওঠে পর্যটক। আর এ পর্যটকদের আশা আকাঙ্খার প্রতি দৃষ্টি রেখেই দেশে দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যটন শিল্প বিস্তৃত হচ্ছে। পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকাশমান ও সম্ভাবনাময় শিল্প। বিশ্বে বিভিন্ন দেশে এই সম্ভাবনাময় শিল্পের যেভাবে দ্রুত প্রসার ঘটছে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে। অথচ এই শিল্পের বিকাশে যেমন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

বাংলাদেশে পূর্বাঞ্চলীয় জনপদের ঐতিহ্যমন্ডিত স্থান হলো ত্রিপুরার পাদদেশে অবস্থিত কসবা অঞ্চল। সমতল ত্রিপুরার খুব গুরুত্বপুর্ণ স্থান হওয়ায় ষোড়শ শতাব্দিতে কসবাকে অস্থায়ীভাবে ত্রিপুরার রাজধানী হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এখানে রয়েছে বহু ঐতিহ্যবাহী দিঘী, বিভিন্ন ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থান, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ সমাধিস্থল, রণাঙ্গণের ঐতিহাসিক স্থান, বধ্যভূমি, সালদা গ্যাস ক্ষেত্র ও বিজনা, বুড়ি, রাজার খাল, সিনাই, তিতাস বিধৌত উর্বর সমতল অঞ্চল। প্রায় ১৯ কিলোমিটার সীমান্ত জুড়ে রয়েছে পাহাড়, টিলা বেষ্টিত সবুজে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম অরণ্য জনপদ। সীমান্তবর্তী কসবা রেলওয়ে স্টেশনের ওপারে ত্রিপুরার কমলা সাগর দিঘী ও মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে বিশাল পর্যটন কেন্দ্র। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ভীড় জমায়। বছরে দুবার মেলা বসে। দেশ বিভাগের পূর্বে এ মেলা ছিল কসবায়। কল্যাণ সাগর দিঘীর পাড় থেকে কমলা সাগর দিঘীর পাড় পর্যন্ত সমতল ও পার্বত্য ত্রিপুরার মধ্যে এ মেলা ছিল মৈত্রীর এক অপরূপ নিদর্শন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিছু সংখ্যক দালাল, রাজাকার ব্যতিত কসবার বৃহত্তর জনগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করে। প্রায় দেড় হাজার মুক্তিযোদ্ধা এখানে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে। তাই এখানকার মানুষ এসমস্ত গৌরবোজ্জ্বল বিষয়াদি নিয়ে গর্ববোধ করে।

কসবা এলাকাটি ছিল ২নং সেক্টরের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের অধীনে। এই সেক্টরের অধীনে মুন্সীগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ ও ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এখানে তিনি ছাড়াও কর্নেল এ.এইচ.এম. গাফফার, ল্যাফটেন্যান্ট জেনারেল হারুন উর রশিদ, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির, মেজর জেনারেল আইন উদ্দিন, কর্নেল হায়দার, শহীদ ল্যাফটেন্যান্ট খন্দকার আজিজুল ইসলামসহ অসংখ্য সেনা কর্মকর্তা যুদ্ধ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা এই এলাকায় রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে কাজ করেছে তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বন্ধু সংসদ সদস্য এডভোকেট সিরাজুল হক, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এমদাদুল বারী, মমতাজ বেগম, আওয়ামীলীগ নেতা সহিদুল হক মাস্টার, গেদু মিয়া, মৌলভী আবদুল জব্বার, ভাষা সৈনিক ডা. ময়না মিয়া, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল কাইয়ুম, ন্যাপের ডা. আবদুর রহমান, আবদুল কাদের বিকম সহ অসংখ্য প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব।

কসবা সদরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা শত্র“মুক্ত হয় ২২ অক্টোবর। ওই রণাঙ্গনে কমলা সাগর দীঘির পাড়ে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ ও ক্যাপ্টেন সুজাত আলী পাকসেনাদের সেলের আঘাতে মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। কসবা রেলওয়ে স্টেশন, বিএডিসি গোডাউন, সালদানদী স্টেশনসহ অসংখ্য স্থানে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের অসংখ্যবার সম্মুখ সমর অনুষ্ঠিত হয়েছে। গুলি ফুরিয়ে গেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচাখুঁচি ও হাতাহাতিও হয়েছে। সালদানদী এলাকায় পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাগুলি ও কম হয়নি। কসবার বায়েক, আকছিনা, রাউৎহাট, হরিয়াবহসহ ৭টি স্থানে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত কসবায় আজও একটি মিউজিয়াম গড়ে ওঠেনি। গড়ে ওঠেনি কোথাও স্মৃতিসৌধ। কুল্লাপাথর সমাধিস্থলকে পর্যটন কমপ্লেক্সের আওতায় নেয়া এ এলাকার জনগণের দীর্ঘ দিনের দাবি।

এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রতি বছরই শত শত পিকনিক পার্টি এসে পিকনিক করে যান। ঘুরে ফিরে দেখেন এখানকার ঐতিহাসিক স্থানসমূহ। দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে (১) কুল্লাপাথর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সমাধিস্থল (বায়েক), (২) লক্ষ্মীপুর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সমাধিস্থল (গোপীনাথপুর), (৩) ভারতের সাবেক প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ঢাকার নবাব পরিবারের প্যারী বানুর পীর নির্মলা সুন্দরী- শ্রীশ্রী আনন্দময়ী আশ্রম ও তার জন্মভিটি (খেওড়া, মেহারী- যেখানে প্রতিবছর দু’বার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী ভক্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়), (৪) মাওলানা আজগর আহাম্মদ সাহেবের মাজার শরীফ (আড়াইবাড়ী, কসবা সদর), (৫) মহেশ ভট্টাচার্য ব্রিজ (বিজনা নদীর ওপর, কসবা সদর) (৬) মইনপুর মসজিদ (স্থাপিত ১২৬৯ হিজরী, কাইমপুর), (৭) মহারাজ ২য় ধর্মমানিক্যের দীঘি- ধর্মসাগর (কসবা সদর), (৮) রাজা ধর্মমানিক্যের স্ত্রী কমলা বতীর নামে কমলা সাগর (বর্তমানে কসবা রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বে ত্রিপুরায়), (৯) কসবা শহরের প্রাণকেন্দ্রে কল্যাণ সাগর দীঘি, (১০) কসবা রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় অর্ধকিলোমিটার দীর্ঘ স্টেশন রক্ষা দেয়াল (১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় এক রাতে নির্মিত) (১১) সালদা গ্যাস ফিল্ড (কুল্লাপাথর-বায়েক)। কুল্লাপাথরসহ এ সমস্ত স্থানগুলোকে পর্যটনের আওতায় নিয়ে এখানে গড়ে উঠতে পারে সুবিন্যস্ত পর্যটন শিল্প। গড়ে উঠতে পারে একটি মিউজিয়াম।

কসবা রেলওয়ে স্টেশনের পাশে, কুল্লাপাথর, লক্ষ্মীপুর ও কল্যাণসাগর দীঘির পাড়ে গড়ে উঠতে পারতো মানসম্মত পর্যটন মোটেল। যেখানে ভ্রমণ পিপাসুরা নিরাপদে থাকতে পারে। সীমান্তবর্তী কসবা উপজেলার উল্লেখিত স্থান সমূহ অরণ্য, নদী, হ্রদ পরিবেষ্টিত। কুল্লাপাথর ও লক্ষ্মীপুর সমাধিস্থল দুটো ভারত সীমান্ত লাগুয়া হওয়ায় পাহাড়ী ত্রিপুরার বনাঞ্চল ভ্রমণ পিপাসুদের হাতছানি দিয়ে বেড়ায়। প্রকৃতির এ সমস্ত দানের মুখোমুখি দাঁড়ালে সৌন্দর্য পিপাসু মানুষের নয়ন-মন ভরে ওঠে। সারা কসবায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ত্রিপুরী রাজাদের নানা কীর্তি ও ঘটনার সাক্ষ্য। স্বাধীন ত্রিপুরী রাজাদের সাথে মোঘল শাসকদের যুদ্ধের লীলাভূমি সেই নবীনগরের বিটঘর থেকে কসবা পর্যন্ত। সৈনিকদের পানীয় জলের সুবিধার জন্যই এখানে অসংখ্য দীঘি গড়ে ওঠেছে, সেই সময়ে। বর্তমান সরকার ত্রিপুরার সাথে যে ট্রানজিট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে যাচ্ছে এটা কসবা দিয়ে স্থাপন করা হলে এখানকার ঐতিহাসিক স্থানগুলোর গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পাবে।

এছাড়া ত্রিপুরার কমলাসাগর পাড়ের পর্যটন কেন্দ্রে ও কসবার ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনে ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের সুযোগ দেয়া যেতে পারে ট্রানজিট ভিসার মাধ্যমে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে এ ব্যবস্থা রয়েছে। এজন্য কসবায় একটি চেকপোস্ট নির্মিত হতে পারে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ স্থানীয় সংসদ সদস্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেন।

পর্যটকদের আগ্রহের কথা বিবেচনা করেই সরকার পর্যটন কর্পোরেশন গড়ে তুলেছেন। সরকার যে সকল পর্যটন মোটেল গড়ে তুলেছেন তা সংখ্যায় খুবই নগন্য। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য পর্যটন শিল্পে অত্যন্ত অগ্রসর। সেখানে প্রাচীন সভ্যতা, মোগল ও বৃটিশ শাসনের নানা স্থাপত্য স্বযত্নে লালন করা হয়েছে। লালন করছে বিভিন্ন ধর্ম যাজকদের নানা স্মৃতি সম্বলিত নিদর্শন; মাজার, মন্দির ও পেগোডা ইত্যাদি। আগ্রার যমুনার পাড়ে সম্রাট শাহজাহানের স্ত্রীর সমাধীস্থল যেমনি পৃথিবীর সকলের হৃদয় বিগলিত করে তেমনি উত্তর প্রদেশের কালপী শহরের অকুন্ঠে গঙ্গাপাড়ে বাল্মিকীর সমাধীসহ শত শত মুসলিম ফকির দরবেশের মাজার শোভা পাচ্ছে। সেখানে সরকার এ সমস্ত বিষয়গুলো পর্যটন শিল্পের আওতায় নিয়ে এসেছে।

নিজের দেশের নানা বিষয় না জানলে, দেশপ্রেম জাগ্রত হবে কোথা থেকে? দেশপ্রেম একদিনে বা রাতারাতি হয় না। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। কসবা শিক্ষা- সংস্কৃতিতে অতীতেও অগ্রসর ছিল। এখানকার মুন্সেফি আদালতে আঠার শতকের শেষ দিকে ভাষা সৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের বাবা চাকুরী করতেন। সেই সুবাদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ঐতিহাসিক কসবা স্কুলে পড়াশোনা করতেন। আজকের কসবা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়টি তখন একটি ইংরেজি মাধ্যমের জুনিয়র বিদ্যালয় ছিল। গোপীনাথপুরে কংগ্রেস নেতা হাবিবুর রহমান, চারগাছের অখিল দত্ত, লাঙ্গল যার জমি তার স্লোগানের প্রবক্তা কৃষক নেতা আব্দুল মালেকসহ বহু নিবেদিত নেতার জন্মস্থান এই কসবা।

এ প্রজন্মের সন্তানরা জানে না মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কসবার মানুষের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা। এ.এইচ.এম. গাফফার, নুরুল ইসলাম গোসাই, জ্যান্ত পাক সেনা ধরতে পেরেছিলেন তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী মোজাম্মেল হক (পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, বিএডিসি), সুবেদার আবদুল ওহাব, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদিরের নাম কে-ই বা জানে? প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা গৌরব গাঁথা, ধ্বংসযজ্ঞ, সমাধিস্থল ইত্যাদি নিদর্শনগুলো নিয়ে এখানে গড়ে ওঠতে পারে উন্নত একটি যাদুঘর। এ সমস্ত বিষয়গুলো ঘিরে পর্যটন শিল্পে কসবা স্থান করে নিতে পারে অনায়েসে।

রাঙ্গামাটি, সুন্দরবন ও কক্সবাজার ছাড়াও যেসকল অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে এদের অন্যতম কসবা। এখানকার সংস্কৃতির বৈচিত্রতা ও নান্দনিকতা মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে। এখানে কুল্লাপাথর ও লক্ষ্মীপুর সমাধিস্থল দুটো ত্রিপুরার পাহাড় ঘেঁষা যে টিলাগুলোতে অবস্থিত তা চোখে না দেখলে অনুভব করা যাবে না। এ সমস্ত স্থানগুলোতে অপরিমেয় শৌর্য বির্য ও দেশপ্রেমের অনাবিল দৃষ্টান্ত মানুষ খুঁজে পায়। তাই শহর ও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসে কুল্লাপাথর, লক্ষ্মীপুর, কসবার কল্যাণ সাগর দিঘীর পাড় প্রান্তিক চত্ত্বর ও কমলা সাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত কসবা রেলওয়ে স্টেশনে। এতে মানুষ খুঁজে পায় হৃদয়ে প্রশান্তি। আর তাই এসমস্ত বিষয়গুলো কাজে লাগিয়ে এখানে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অমিত সম্ভাবনা।

No comments

Thanks

Theme images by compassandcamera. Powered by Blogger.